🖋ডেস্ক রিপোর্ট | বঙ্গ মিরর :
ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে মুসলিম বিশ্বে একটা নতুন মেরুকরণ হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ ইসরায়েলের ব্যাপারে তাদের বৈরি অবস্থান নমনীয় করেছে। গত কয়েক মাসে হোয়াইট হাউসের মধ্যস্থতায় ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), বাহরাইন, সুদান ও মরক্কো। এখন এই সংখ্যা আরও বাড়াতে চাচ্ছে নেতানিয়াহু প্রশাসন।
সৌদি আরবও ইসরায়েলের সাথে অলিখিত একটা সম্পর্ক তৈরি করেছে, এমন কথা শোনা যায়। এমনকি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর গোপনে সৌদি আরব সফর এবং যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে বৈঠকও অনেক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।
অনেকে মনে করেন, ইসরায়েল ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের একটি প্রক্রিয়ার মধ্যস্থতা করছে আমেরিকা। তবে ইসরায়েলের স্বীকৃতি পাওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বিকল্প নেই বলে সম্প্রতি জানিয়ে দেন সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
এরপরও ইসরায়েলের প্রচেষ্টা থেমে নেই। ইসরায়েলের রাজধানী জেরুজালেম থেকে হারিন্দর মিশ্র নামে একজন ভারতীয় সাংবাদিক গত সেপ্টেম্বরে বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, বাংলাদেশের স্বীকৃতি পেলে গুরুত্বের সঙ্গে স্বাগত জানাবে ইসরায়েল।
ওই সময় তিনি বলেন, ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়াতেও নতুন সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করছে। ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এশিয়া নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে। এতে সাংবাদিক হারিন্দর মিশ্র উপস্থিত ছিলেন।
‘একটা প্রেস কনফারেন্স হয়েছিল। তাতে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। এটি ছিল মূলত এশিয়ার দেশগুলোর সাথে ইসরায়েলের সম্পর্ক নিয়ে। সাংবাদিকরা দক্ষিণ এশিয়া সম্পর্কে ইসরায়েলের অবস্থান জানতে চেয়েছিলেন। জবাবে ইসরায়েলের ওই কর্মকর্তা বলেন, ইসরায়েল সবার সঙ্গে সম্পর্ক করতে চায় এবং সবার সঙ্গে সর্ম্পক স্থাপনের একটা চেষ্টাও হচ্ছে।’
অর্থ্যাৎ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর পাশাপাশি এশিয়ার মুসলিম দেশগুলোর দিকেও নজর রয়েছে ইসরায়েলের। এখন এই ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান কী হবে, এই প্রশ্নের উত্তরে বার্তাসংস্থা রয়টার্স বলছে- ইসরায়েলের সঙ্গে এ ধরনের সম্পর্ক রাজি নয় বাংলাদেশ। তবে ফিলিস্তিনিদের অধিকার ও দ্বি-রাষ্ট্র তত্ত্বের প্রতি সংহতি জানিয়ে বরাবরই অবস্থান পরিষ্কার করেছে বাংলাদেশ।
গত ২৯ নভেম্বর ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি সংহতিবিষয়ক জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক দিবসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত একটি বার্তাও প্রকাশ করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই ফিলিস্তিনিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতি সংহতি জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ।
বার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পূর্ব জেরুজালেম-আল কুদস আল শরিফকে রাজধানী রেখে দ্বি-রাষ্ট্র তত্ত্বের আঙ্গিকে ১৯৬৭ সালের সীমানাভিত্তিক একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে আমরা আমাদের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করছি।’
ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকারের প্রশ্নে তিনি জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যর্থতার কথাও তুলে ধরেন। ইসরায়েলি সেনাদের ‘দখলদার’ উল্লেখ করে অবিলম্বে ফিলিস্তিনিদের ঘর-বাড়ি ধ্বংস এবং অধ্যুষিত এলাকায় ইসরায়েলিদের বসতি স্থাপন বন্ধের আহ্বান জানান শেখ হাসিনা।
স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি বিরোধে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারে স্পষ্ট। ফিলিস্তিনিদের স্বতন্ত্র-স্বাধীন রাষ্ট্রের পক্ষে বাংলাদেশ বলিষ্ঠ অবস্থান নিয়েছে শুরু থেকেই। এমনকি এ কারণে ইসরায়েল ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে চাইলেও তা গ্রহণ করেনি ঢাকা।
বাংলাদেশের এই অবস্থানে যে অদূর ভবিষ্যতেও কোনও পরিবর্তন আসবে, তেমন সম্ভাবনা একেবারেই দেখছেন না বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, এর কারণ যতটা না আন্তর্জাতিক, তার চেয়ে অনেক বেশি বাংলাদেশের জনমত এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতি।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শুরুর দিকে যে কয়েকটি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাব করেছিল, তার মধ্যে ছিল ইসরায়েল। ১৯৭২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাব দেয় ইসরায়েল।
তখন স্বাধীন বাংলাদেশের শেখ মুজিবুর রহমান নেতৃত্বাধীন সরকার লিখিতভাবে ইসরায়েলের স্বীকৃতি প্রত্যাখ্যান করে। সেই অবস্থানের পেছনে মূল বিষয় ছিল ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সমর্থন। ৫০ বছর পরও ইসরায়েল প্রশ্নে বাংলাদেশের সেই অবস্থানে কোনও পরিবর্তন আসেনি।
এদিকে, ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের আগ্রহ নেই বাংলাদেশের। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের অবস্থান আগের মতোই রয়েছে।’
অবশ্য গত বুধবার রয়টার্সে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তার নাম প্রকাশ করা হয়নি। তবে গত সেপ্টেম্বরে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বিবিসি বাংলা’কে বলেছিলেন, কোনও রাজনৈতিক ঝুঁকি বা সমস্যা বর্তমান সরকারের বিবেচ্য বিষয় নয়। বাংলাদেশ নৈতিকতার জায়গা থেকে ফিলিস্তিনি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পক্ষে রয়েছে এবং থাকবে।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খুব পরিষ্কারভাবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এ কথাটি বলেছেন যে, আমরা প্যালেস্টাইনের জনগণের পক্ষে আছি, আমরা একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে আছি। এই নীতিতে আমরা বিশ্বাস করি। সেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের সাথে ইসরায়েলের সম্পর্কবিহীন যে পথ চলা, সেটা অব্যাহত থাকবে।’
বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের বিশ্বের একটি দেশেই যাওয়া নিষেধ, সেটি ইসরায়েল। পাসপোর্টে সেটি স্পষ্ট করে লেখা আছে। ৭০ ও ৮০-র দশকে বাংলাদেশের অনেক তরুণ স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও গিয়েছিলেন। সে সময় ঢাকার রাস্তায় ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে ইসলামপন্থী বিভিন্ন দল বা সংগঠনের মিছিল ছিল নিয়মিত ঘটনা। বাংলাদেশের মানুষের মাঝে ইসরায়েলবিরোধী আবেগ খুবই জোরালো।
বঙ্গ মিরর/এসআর