তাসনিম ইসলাম
আজকাল চোখে বড্ড ঝাপসা দেখি। ভাঙ্গা চশমাটা চোখে পরে জানালার দিকে তাকালাম। সূর্যের লাল আভা যেন চারিদিকে আলোকিত করে দিয়েছে। সবুজে সবুজ হয়ে আছে চারপাশ। কি যে মায়াবী সুন্দর প্রকৃতি।
এই যে বড় মা চলেন বাইরে গিয়ে একটু হেটে আসি।
না গো, শিউলি আজ আর যাচ্ছি না। পায়ে বড্ড ব্যাথা, বয়স হয়েছে তো তাই হয়ত শক্তি টাও কমে যাচ্ছে।
ওমা সে কি,,, আচ্ছা আমি পায়ে একটু মালিশ করে দিই।
না এখন থাক, তুমি যাও হাটতে, পরে না হয় মালিশ করে দিও।
না না, আপনাকে এভাবে রেখে যাওয়া যায় নাকি…
আচ্ছা তোমার যদি মন চাই তাহলে একটু না হয় মালিশ করেই দাও।
(পায়ে মালিশ করতে করতে শিউলি বলল)
বড় মা, কিছু কথা জিজ্ঞেস করি?
হ্যাঁ।
আপনি কতদিন ধরে এই বৃদ্ধাশ্রমে?
তাও প্রায় ১০ বছর।
তাহলে তো অনেক দিন। কি এমন হয়েছিল বড় মা??
বৃদ্ধাশ্রমে আসতে কারো কারণ লাগে নাকি পাগলি, তুমি আগে বলোতো, এত কম বয়সে তুমি এখানে কেন? তারপর আমি বলি।
বড় মা, কম বয়স আর কই…ছেলে বিয়ে করেছে, নতুন বউমা আমায় পছন্দ করেনা। টুকটাক রোজ আমার দোষ ধরত ছেলের বউ, ছেলে বউ এর কথামতো চলে, আর আমার ছেলের বাবা এক দূর্ঘটনায় মারা গিয়েছে আজ ৩ বছর হলো। তারপর কিছুদিন পরেই আমায় বিদায় করল আমার ছেলে আর ছেলের বউ। এইতো আর কি। খারাপ লাগেনা আর অমন ছেলের জন্য। আমি এখানেই ভালো আছি। শুধু মাঝে মাঝে……. যাকগে আমার কথা বাদ দিই,এবার আপনি বলেন বড় মা।
কি বলব বলো…..আমার ছেলের নাম ছিল খোকা। ওর বাবা নেই ও যখন অনেক ছোট ছিল তখন থেকেই, আমি অনেক কষ্টে মানুষ করেছিলাম আমার খোকা কে, সে বড় অফিসার ও হয়েছিল। আমার ছেলে নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছিল। আমাকে বলেও নি। শহরে নতুন ফ্ল্যাট এ বউকে নিয়ে থাকত |আমায় দেখাশোনা করার মতো ও কেউ ছিল না, আমার ছেলে যখন আমার সাথে দেখা করতে আসত তখন গ্রামের লোকেরা বলত ” মা কে নিয়ে যা খোকা শহরে, আর কতদিন একা থাকবে তোর মা?” তখন খোকা বলত হ্যাঁ নিয়ে যাব।
হঠাৎ একদিন খোকা এসে বলল মা চলো আজ তোমায় শহরে একবারে নিয়ে যাব। আমি তো মহাখুশি। তারপর নিয়ে এলো এখানে। আমি বললাম বাবা কোথায় নিয়ে এলি আমায়?? খোকা বললঃ মা এখানেই তুমি থাকবা, আসলে তোমার বউমা বাড়তি ঝামেলা নিতে চাই না, আমি মাঝে মাঝে আসবো…. একদিন খবর পেলাম আমার ছেলে ও তার বাবার মতো হারিয়ে গেছে। আল্লাহর কাছে এখন শুধু বলি যে আমার খোকার সব গুনাহ তুমি মাফ করে দিও আল্লাহ ।
একি শিউলি তুমি কাঁদছ কেন?
(কাঁদতে কাঁদতে শিউলি বলল) বড় মা আমায় মাফ করে দিয়েন বড় মা।
আমি মুসকি হেসে বললাম আমি মাফ করার কে শিউলি, খুব ইচ্ছে ছিল জানো তো নিজের ছেলের বউ কে দেখা। আর আজ দেখো আমার সেই ইচ্ছে অনেক আগেই পূরণ হয়েছে। এখন তুমি আমি ঠিক এক ই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে। তুমি যেমন টা করবে দুনিয়ায়, ঠিক তেমনটাই দুনিয়ায় ফল পাবে।
কিন্তু বড় মা জানলেন কি করে যে আমি………..
হঠাৎ শিউলির ঘুম ভেঙ্গে গেল, আজ তার বড় মায়ের ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী। সে আজও সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই নি।
সে দিন গুনছে যেন এমন কাহিনি আর কোন শিউলি কে সে না শোনাতে পারে…..
সে ও তার বড় মায়ের মতো জানালায় তাকিয়ে প্রকৃতি দেখে…. তার কানে বেজে উঠল সেই কথাটি…..
“তুমি যেমনটা করবে দুনিয়ায়, ঠিক তেমনটাই দুনিয়ায় ফল পাবে।”
লেখক:
কবি ও শিক্ষার্থী,
ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক।